ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলা গানে রেনেসাঁর পথ প্রদর্শক চারণকবি বিজয় সরকার 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৩৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

‘যেমন আছে এই পৃথিবী / তেমনিই ঠিক রবে/ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে...’ মায়ার বাঁধন ছেড়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়ায় এই চিরন্তন উপলদ্ধি আজো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। 

শুধু মরমী, দেহতত্ত্বই নয়, বিজয় সরকারের বিচরণ গানের সব শাখাতেই।  যেমন প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে লিখেছেন-‘তুমি জানো নারে প্রিয়/ তুমি মোর জীবনের সাধনা’সহ অসংখ্য গান।

আধ্যাত্মিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজয় সরকার গেয়েছেন-‘নবী নামের নৌকা গড়/ আল্লাহ নামের পাল খাটাও/ বিসমিল্লাহ বলিয়া মোমিন/ কূলের তরী খুলে দাও...।’ কিংবা ‘আল্লাহ রসূল বল মোমিন/ আল্লাহ রসূল বল/ এবার দূরে ফেলে মায়ার বোঝা/ সোজা পথে চল...।’ স্ত্রী বীনাপাণির মৃত্যুর খবরে গানের আসরেই গেয়েছেন-‘পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী/ ওরে একদিন ভাবি নাই মনে/ সে আমারে ভুলবে কেমনে...।’

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘নকশি কাথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের নায়ক-নায়িকা ‘রূপাই’ ও ‘সাজু’র প্রেমকাহিনী নিয়ে বিজয় সরকার গেয়েছেন-‘নকশি কাঁথার মাঠেরে/ সাজুর ব্যাথায় আজো রে বাজে রূপাই মিয়ার বাঁশের বাঁশি...।’ ‘কী সাপে কামড়াইলো আমারে/ ওরে ও সাপুড়িয়ারে/ আ...জ্বলিয়া পুড়িয়া মলেম বিষে...।’ 

কালজয়ী এই গানের গীতিকার একুশে পদকপ্রাপ্ত চারণকবি বিজয় সরকারের ১২০তম জন্মদিন ২০ ফেব্রুয়ারি।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরশ্রষ্টা কবিয়াল বিজয় সরকার ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদরের নিভৃতপল্লী ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।

প্রায় প্রায় দুই হাজার গান লিখে তাতে সুরও দিয়েছেন বিজয় সরকার । কবিগানে অশ্লীলতা বিবর্জিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে বাংলা গানের ভান্ডারে রেনেসাঁর অভ্যুদয় ঘটান কবিয়াল বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। তাই তাকে চারণকবি বলা হয়। 

কলকাতার ভারতীয়ভাষা পরিষদ তাঁকে চারণকবি সম্রাট বলে অভিহিত করেন। তারা তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিয়াল ও ভাটিয়ালী গানের রাজা বলেও সম্মানিত করেন। 

বাংলাদেশের বিখ্যাত কবিয়াল ও চারণকবি বিজয় সরকার ওরফে বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী ১৯০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি (১৩০৯ বঙ্গাব্দের ৭ফাল্গুন) নড়াইল জেলার সদর থানার ডুমদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে সবাই পাগল বিজয় বলেও ডাকতেন।  

চারণকবি বিজয় সরকারের পূর্বপুরুষ ছিলেন বৈরাগী। ওই বৈরাগী সমাজের বসতি ছিল যশোর। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে বিজয় সরকারের পূর্বপুরুষ বর্তমান নড়াইল সদরের শহরতলি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে বিলের মাঝে কয়েকটি টিলার উপরে অবস্থিত ডুমদী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।  

বিজয় সরকারের পিতার নাম নবকৃষ্ণ বৈরাগী এবং মাতার নাম হিমালয়কুমারী বৈরাগী। বৈরাগী বংশের সন্তান বিজয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বংশের নাম পরিবর্তন করেন এবং বৈরাগীর পরিবর্তে অধিকারী নাম যোগ করেন। তখন বৈরাগীর পরিবর্তে তাঁর নাম হয় বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। 

তৎকালীন সময়ে কবিয়াল নিম্নার্থে ব্যবহার করা হতো। তাই কবিয়াল বিজয় নিজেকে 'চারণকবি' হিসেবে প্রচার করেন। 

কিশোর বয়স থেকেই বিজয় সরকার সংগীতের প্রতি ব্যাপক আকৃষ্ট ছিলেন। মাঠে-ঘাটে, ধানক্ষেতের আল পথ দিয়ে তিনি নিজের মনে নিজের সুরে গান গেয়ে বেড়াতেন। ওই গানের কথা ও সুর কারো কাছ থেকে শোনা কিংবা শেখা নয়। 

নিজেই তাৎক্ষণিক রচনা করে তাতে সুর দিয়ে গাইতেন তিনি। কিশোর বয়সেই পঞ্চানন মজুমদার , পুলিনবিহারি প্রমুখ গ্রাম্য কবিয়ালদের সাথে পাঁচালি গানে পাল্লা দিয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। এসময় গিরিশচন্দ্র সরকার বিজয় সরকারকে সংগীতবিদ্যায় উৎসাহিত করেন ও তালিম দেন। 

গিরিশচন্দ্র বিজয় সরকারের পিতা নবকৃষ্ণকে বলে তাঁর গানের দলে বিজয় সরকার কে অন্তভুক্ত করেন। ইতোমধ্যে বিজয় সকার গোপালপুর কাঁচারির নায়েব নিযুক্ত হন এবং সংগীত চর্চা অব্যাহত রাখেন। বাংলা ১৩৩৩ সনের কথা। 

তখন তিনি হোগলাডাঙ্গায় ফরিদপুরের মনোহর সরকার ও খুলনার মনোহর সরকারের মধ্যে পালা গান হয়। বিজয় সরকার সেই পালা গান শোনেন।

গান শুনে মুগ্ধ হয়ে মনোহর সকার তাঁকে কবিগান শিখাতে আগ্রহী হন এবং দু বছর তালিম দেন। পরবর্তীতে রাজেন সরকারের কাছে এক বছর তালিম নেন। কিশোর বয়স থেকেই বিজয় সরকার সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এবং ওস্তাদ গনের কাছ থেকে কবিগান শেখার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। 

তার গাওয়া কবিগানের স্তর গুলো হলো: ক) ডাক বা ধরা বা আগমনী: দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে আসর বন্দনা খ) মালসী বা ভবানী বিষয়ক গান: ইষ্টের কাছে অভিষ্ট প্রার্থনা গ.) সখি সংবাদ: শ্রী কৃষ্ণের প্রতি নায়িকা রাধার প্রেমার্তিমূলক গান ঘ.) কবিগান: সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক রচিত গান ঙ.) টপ্পা: প্রশ্ন করা ও জবাব দেয়া হয় চ.) পাঁচালি বা ছড়া: ত্রিপদী ছন্দবদ্ধ বক্তৃতা ছ) কবির ধুয়া: ভাটিয়ালি গান জ.) পয়ার: আসর শেষে বিদায়কালীন গান এবং সবশেষে পরিবেশিত মিলন সংগীত। 

বিজয় সরকারের রচিত গানের সংখ্যা হবে তিনশত পঞ্চাশের মতো। তবে এপর্যন্ত তার গানের যে সংকলন প্রকাশ পেয়েছে তাতে মত ২৭০ টি গান স্থান পেয়েছে যা লোকসঙ্গীতের অসাধারণ সম্পদ।

বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি আনুমানিক ৪০০০ আসরে কবিগান পারিবেশন। তার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অসংখ্য গান রয়েছে। 

বিচ্ছেদ গান গুলোর মধ্যে তুমি জানো না রে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা; আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে প্রাণ সজনী একদিন ভাবি নাই মনে; আমার কথক মনে রইলো শ্যামল বংশীওয়ালা;  কত ভালো লাগে তোমারে কিশোর বন্ধু বাঁশরিয়ারে; 

মুর্শিদতত্ত্বের মধ্যে আছে জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কী; ভাবতত্ত্বের মধ্যে এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে; আমি কার নৌকায় উঠিব ভাবি তাই  ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয় গান। 

'আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে প্রাণ সজনী'- গানটি বিজয় সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি গান। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, ১৩৫২ বঙ্গাব্দে বিজয় সরকারের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফেরার পথে এই গানটি রচনা করেন।

বিজয় সরকার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সততা, নিষ্ঠা, কর্মের গুন বিচার করে তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেন। বহু মুসলমানকে তিনি অতি আপন করে নিয়েছেন এবং মুসলমানরাও তাকে আপন লোক ভাবতো। 

কবিয়াল বিজয় সরকার ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার হিন্দু-মুসলিম নর-নারীর আধ্যাতিক গুরু। কিন্তু তিনি গুরুগিরির বিনিময়ে কোন অর্থ- কড়ি নিতেননা। 

শ্রী শ্রী পাগল বিজয়ামৃত পুস্তক মতে জানা যায় যে, বাংলাদেশের জনৈক মুসলিম এক ব্যক্তির চোখ বন্ধ হয়ে গেলে বিজয় সরকার ১৩৩৬ সালে ৫০ বছর বয়সে তাঁর নিজের চোখ দুটি দান করে সেই মুসলিম ব্যক্তির দৃষ্টিদান করেন। এরপর তিনি চিরকালের জন্য অন্ধত্ব বরণ করেন। এরকম আরো অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো বিজয় সরকারের অসাম্প্রদায়িক মননের প্রমান। 

কবিগানকে অশ্লীলতার ধারা থেকে বের করে আনেন চারণকবি বিজয় অধিকারী। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসিম উদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, তৎকালীন ইংরেজি জানা ডিরোজারিও শিষ্যদের সংস্পর্শে আসেন বিজয় সরকার। 

তিনি গানে তন্ময়তা, মন্ময়তা, অনুভব, যুক্তি ও জীবন নিষ্ঠতার এমন এক সমন্বয় সাধন করেছেন যার জন্য কবিয়াল সমাজে তিনি সর্বোচ্চ আসনে আসীন। কবিয়াল বিজয় সরকারের সাবলীল ও সতর্ক শব্দ প্রয়োগ, বাচনভঙ্গির আভিজাত্য কবিগানকে এক অনন্য শালীন রুচি দিয়েছে।  

বিজয় সরকার শেষ জীবনে অন্যকে চক্ষুদান করে অন্ধত্ব বরণ করেন। তৎকালীন কলকাতার পিজি হাসপাতাল ও ভারতের আরো কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা করেও তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফেরানো যায়নি। শেষ বয়সে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তার নিজ বাড়ি থেকে কন্যা কানন বিশ্বাসের বাড়িতে স্থানান্তরিত হন। আমৃত্যু তিনি সেখানেই ছিলেন। 

১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের হাওড়ার বেলুড়ে এ ধরার মায়া ত্যাগ করে সুন্দর ওই পৃথিবী রেখে ৮১ বছর বয়সে ওপারে চলে যান। পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। 

এমএম/এএইচএস


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি